কোনও কোনও জায়গার বিশেষ কোনও উপাদানের সহজলভ্যতা, জলবায়ুর প্রকৃতি আর দক্ষ কারিগরের উপস্থিতি এবং একই সঙ্গে স্থানীয় চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয় বিশেষ বিশেষ মিষ্টি। এবং সেই সব মিষ্টি ক্রমে জনমনে প্রভাব বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে শহর, জেলা, রাজ্য ছাড়িয়ে আরও দূর দেশে এই মিষ্টিগুলি এক একটি স্থানের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, ওই গ্রাম বা শহরের নাম করলেই সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে যুক্ত বিশেষ মিষ্টিটির কথাও এসে পড়ে। স্থানীয় ব্যক্তিরা এই মিষ্টিটির জন্যে শুধু গর্ববোধই করেন না, মিষ্টিটি তাঁদের সাংস্কৃতিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
শক্তিগড়ের ল্যাংচা বা জনাইয়ের মনোহরার মতো বিখ্যাত সিউড়ির মোরব্বা। নানা ধরণের কাঁচা ফলার সবজি কেটে, সেগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে সেদ্ধ করে মিষ্টি রসে ডুবিয়ে তৈরি হয় মোরব্বা। মোরব্বা বেশ প্রাচীন মিষ্টি এবং আর প্রস্তুত কৌশলও বিশেষভাবে প্রণালীবদ্ধ।
ইতিহাস জানাচ্ছে, মোরব্বা আদতে আরব থেকে আগত।শব্দটা হচ্ছে 'মুরববা'। মানে,চিনির বা মিছরির রসে পাক করা ফল বা মূল। এই আরবদের কাছ থেকে মোরব্বা তৈরির 'নো- হাউ' শিখে নিয়েছিল পোর্তুগিজরা।
একসময় রকমারি মোরব্বা তৈরি হতো। বিশেষ বিশেষ দোকানের মোরব্বা-বিশেষজ্ঞ কারিগরের কারণে বিখ্যাত হয়ে উঠতো সেই সব দোকান। তাঁরা পুরুষানুক্রমে এই কাজ করে আসতেন। টাটকা সব্জী ছাড়াও সেদ্ধ করার কেরামতিতেও মোরব্বার স্বাদের হেরফের ঘটে। এরপরেও আছে চিনির রস প্রস্তুতের জটিল গণনা! বিভিন্ন ফল বা সবজির জন্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির রস। আপনি ভাবুন, সবজী যে রকমই হোক না কেন,তাকে মিষ্টত্ব গ্রহণ করতেই হবে। বিবাহের পর মহিলাদের পদবীর মত। নাহলে উচ্ছের মোরব্বা কখনও মিষ্টি হয়!
বীরভূমে মোরব্বার প্রচলন শুরু করেছিলেন সেখানকার শাসনকর্তা রাজা বাদিওজ্জমান খাঁ।সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ।
তখন বীরভূমের রাজধানী ছিল রাজনগরে।তাঁর রাজত্বকালে রাজনগরকে সবদিক দিয়ে উন্নত করে তুলেছিলেন। দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা ধরনের ফুল ও ফলের গাছ আমদানি করে তিনি রাজনগরে অত্যন্ত যত্ন সহকারে সাজিয়ে তুলেছিলেন এবং পরিচর্যার জন্য দক্ষ পরিচালকদের নিয়োগ করেছিলেন। উন্নত মানের পেঁপে, কামরাঙা,আতা,আম, জাম, কাঁঠাল, বেল, কুল ইত্যাদি ফলের গাছে ভরিয়ে তুলেছিলেন শহরকে। বাদিওজ্জমান খাঁ এইসব ভালো ফলের সংরক্ষণের জন্য বীরভূমে প্রথম মোরব্বার পরিকল্পনা করেছিলেন।মোটামুটি জানা যায় , প্রথম দিকে মোরব্বা তৈরি হয়েছিল বেল, পেঁপে আর চাল কুমড়োর।ক্রমে অন্যান্য ফলের মোরব্বা ভিয়েনে জায়গা করে নেয়। শহর ছাড়িয়ে,জেলা ছাড়িয়ে মোরব্বার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।অন্যান্য জেলার মোদকেরাও মোরব্বা তৈরি করতে শুরু করে।তবে একটি জিনিসের মোরব্বা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।সেটা হলো,এক ধরণের জংলী গাছের কন্দমূল, শতমূলীর মোরব্বা। ওষধি গুণসম্পন্ন এই মোরব্বার চাহিদা থাকলেও এখন আর সেভাবে পাওয়া যায় না। আমাদের চন্দননগরে বেল আর চালকুমড়ার ছাড়া অন্য কিছুর মোরব্বা তেমন চোখে পড়েনি।
গতকাল সিউড়ি গিয়েছিলাম। সেখানকার অধিবাসী চয়ন দাস ঠাকুরের বদান্যতায় শহরের অন্যতম সেরা দোকান থেকে মোরব্বা নিয়ে এলাম। আমার ধারণা ছিল না,এখনও এতো রকমের মোরব্বা তৈরি হয়!বেশ কয়েকপ্রকার ফল আর সবজীর থাকলেও মাত্র দু'রকমের মোরব্বা নিলাম,আমলকী আর চেরির। আসলে বুঝতে পারছিলাম না,কেমন স্বাদ হবে!বাড়িতে এসে টেস্ট করে বুঝলাম, কেন সিউড়ির মোরব্বার এতো নাম।এখানকার মতো বেশি ক্যাটক্যাটে মিষ্টি নয়।চমৎকার স্বাদ।
ও, বলতে ভুলে গেছি,এখানকার আচারও বেশ বিখ্যাত। এক শিশি পাঁচমিশালি আচারও নিয়ে এসেছি
Info & Image Courtesy : Debasish Mukherjee
No comments:
Post a Comment