Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Sunday, July 21, 2024

আতঙ্কের নাম অজয় নদ

 


যে নদীকে জয় করা যেত না একদিন, বর্ধমান থেকে লুপলাইনে যেতে বোলপুরের ঠিক আগেই ভেদিয়া, ভেদিয়া স্টেশন পেরোলেই অজয়ের উপর ব্রিজ, তারপরই বোলপুর। অজয়ের অবস্থা দেখে অজয়ের অতীত বোঝা যায় না। শুধু অজয় কেন, এই অঞ্চল অজয়, কুনুর আর কোপাই- এই তিন নদীর বহমানতায় জীবন্ত। কুনুর দেখলে এখন অবশ্য নদী বলে চেনা যাবে না। কোপাই নদী দেখলেও মনে হবে খাল। এই অঞ্চলেই ১৯৬২-৬৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ চলে অজয়ের অববাহিকায়। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ২,০০০ খ্রিষ্টপূর্বের ইতিহাস। এই অঞ্চলে আর্যদের এসে বসতি গড়ারও আগের ইতিহাস। আবিষ্কৃত হয় পাণ্ডু-রাজার ঢিবি।

দ্বিতীয় মিলেনিয়াম বিসিতে (মিলেনিয়াম= ১০০০ বছর, বহুবচনে মিলেনিয়া। ১০০০ বিসি থেকে ১বিসি হচ্ছে প্রথম মিলেনিয়াম বিসি, এইভাবে হিসেব হয়) অজয়-অববাহিকায় বসবাসকারীরা শহর পত্তন করেন। তাঁদের শহরে রাস্তা, ফুটপাথ ইত্যাদি সবই ছিল। বাড়ি বলতে দুর্গ অথবা নলখাগড়ার সঙ্গে লাল কাঁকুড়ে-মাটি পাইল করে দেওয়াল তোলা মাটির বাড়ি। বাড়ির আকার মূলত আয়ত-গোলাকার, অথবা গোলাকার। কিছু বাড়ির ছাদে টেরাকোটার কাজের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। তাদের মূল জীবিকা ছিল বাণিজ্য। এছাড়া চাষবাস, পশুপালনেও তাদের অংশগ্রহণের চিহ্ন পাওয়া গেছে। মাটির জিনিস তৈরিতে পটু ছিলেন তারা। অধিবাসীদের তামার ব্যবহারও জানা ছিল। পাণ্ডু-রাজার ঢিবিকে ধরা হয় বাণিজ্যিক শহর হিসেবে। এই অঞ্চলের বণিকরা শুধু ভূখণ্ডের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে অংশ নিতেন এমন নয়। ভেবে কূল পাওয়া যায় না জানলে, যে তারা বহির্দেশীয় বাণিজ্যেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। দক্ষ, কুশলী এই মানুষদের নৌবহর সাতসমুদ্রে পাড়ি জমাত, যখন এই গ্রহের মাপ, আন্দাজ করা মানচিত্র ছিল বলে শোনা যায়না। ভূমধ্যসাগরীয় ভূখণ্ডের জাতিগুলোর সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কের দহরমমহরম ছিল। নীল জল, সাদা বালির দেশ ক্রীট দ্বীপের মানুষদের ব্যবহৃত শীলমোহর, বাণিজ্যিক চুক্তির প্রমাণ পাওয়া গেছে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ থেকে। শুধু তাই নয় ক্রীট এবং মিশরীয়রাও এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক স্বার্থে এসে বসত গড়েছিলেন, তার নিদর্শনও পাওয়া যায়। তমলুকে পাওয়া (তাম্রলিপ্ত) মিশরীয় শিল্পরীতিতে তৈরি পাত্র, চন্দ্রকেতুগড়, হরিনারায়ণপুরে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক সামগ্রী এই বক্তব্যকে সমর্থন করে।


রেলের ব্রিজ দিয়ে গেলে অজয়কে দেখা যায়। অজয়ের প্রবাহ বোঝা যায়না। অথচ নদ-নদীর প্রবাহ তো জীবন্ত হয়। অথচ মশামাছির মত, মানুষের মত, অজয়ের চরায় গজানো উঁচু উঁচু ঘাসবন, কাশবনের মত নদীরও তো জীবন থাকে। অথচ অজয়ের দেহ জুড়ে খোঁড়া খোঁড়া বালির চর। ৮ চাকা, ১০ চাকা লড়ি। অথচ, নদীনির্ভর সভ্যতার চিহ্ন খুঁড়ে খুঁড়ে পাওয়া যায়। আমরাও খুঁড়ে খুঁড়ে আমাদের অতীত খুঁজে পাই। অথচ, নদীর গর্ভ খুঁড়ে বালি তুলে তৈরি করি আমাদের বর্তমান। সিমেন্টবালির সভ্যতা। কোপাইয়ের পাড়ে পিকনিক হয়, বক্সে গান বাজে, থার্মোকলের পাতা, প্লেট, প্লাস্টিকের মোড়ক ছড়িয়ে থাকে। গড়িয়ে যায় নদীতে। নদী মুখ বুজে নিজের খেয়ালমত সব ছড়িয়ে দেয়। নিজের গর্ভে জমাতে থাকে। অজয়ের বুক থেকে বালি ওঠে। অজয় সরে যায়। জল সরে আরও বালি বেরিয়ে পরে। অজয় বাঁক বদলায়। জলের গতি রুদ্ধ হয়। নদীর মাঝবরাবর চলে যেতে পারে ট্রাক, লড়ি। বালি লোড করে চলে যায়। পরদিন আবার আসে। প্রতিদিন আসে। নদীর গতিপথকে আড়াআড়ি কাটা রেলপথে আমরা চলাচল করতে থাকি। একে একে রেলব্রিজ দিয়ে পেরতে থাকি কুনুর, অজয়, কোপাই, বক্রেশ্বর, ময়ুরাক্ষী, ব্রাহ্মণী, বাঁশলই। তিন ঘন্টায় ৭ খানা নদী পেরনো হয়ে যায়। আমাদের দৈনন্দিন ট্রেনযাত্রা, আমাদের জীবনপ্রবাহ আড়াআড়িভাবে ছেদ করে যায় নদীর প্রবাহকে। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। 


প্রসঙ্গত, কেরল বিগত ১০০বছরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যাপরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে এখন। ৪৪টি নদীর উপর ৪২টি বাঁধ রয়েছে, যার প্রায় সবকটা থেকেই জল ছাড়তে হয়েছে। কেরলের পেরিয়ার নদীর উপর অসংখ্য ছোট-বড়ো ব্রিজ, জলবিদ্যুত প্রকল্প, সেঁচবাঁধ ইত্যাদি ভাসিয়ে পেরিয়ার নদী ফুঁসছে। নদী সর্বংসহা। কিন্তু নদীর প্রবাহ রুদ্ধ হলে নদী তার খেয়ালেই স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করবেই।


নদী আসলে বহমান ইতিহাস। বহমান পরম্পরা। অজয় ফিরে এসেছে কত পাঁচালিতে, গানে, কবিতায়। “বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদীর বাঁকে,/জল যেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে"। কেঁদুলির জয়দেবের মেলাও আসর পাতে এরই পাশে। সহজিয়াদের গানেও মিশে যায় অজয়ের গাঙে পানি আসার গূহ্য কথা। আর, সেই কবে মেগাস্থিনিস  অ্যামিস্থিস নামের একটি নদীর কথা লিখেছিলেন, ঐতিহাসিক অ্যালফ্রেড বলেছেন সেই নদীই নাকি অজয়। যাকে জয় করা যায় না। অথচ, আজকের অজয়কে দেখলে মনে হবে বড়ো ক্ষীণ, বড়ো পরাজিত, বড়ো বৃদ্ধ একটা নদী নিজের ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়েই ধুঁকছে। হয়তো কোনও এক কালান্তক জলোচ্ছাসে ফের একদিন দুকূল ভাসিয়ে দেবে সে। সেই জল কোত্থেকে এল, মরা অজয়ে বান এল কীভাবে—ভাবার আগেই ঘরছাড়া হয়ে যাবে হাজারো মানুষ। গন্ধগোকুল, বেঁজির মতো অসংখ্য প্রাণীর প্রজনন মাসে ভেসে যাবে তাদের অস্তিত্বও। আর আমরা? তখনও বোকার মতো হিসেব কষব কতখানি অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত দায়ী এর জন্য! নাকি, একবার তাকাব এখনকার অজয়ের দিকে? শুধু অজয় না, কুনুর, কোপাইদের দিকেও। বালি ওঠা, ছাল ওঠা, মরতে বসা আমাদের অতীতের সম্পদ। আমাদের হাতে মরতে মরতে একদিন যদি প্রতিশোধ নিতে চায় এরা! 


চীনে একটা প্রবাদ ছিল, ‘নদীকে না দেখলে, নদীও তোমায় দেখবে না। আর, নদী দেখা বন্ধ করলেই-- সব শেষ!’


সংগৃহীত-

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot