Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Thursday, August 15, 2024

বীরভূমের রাইপুর রাজবাড়ি



 বোলপুর শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইলামবাজার যেতে বা ধারেই পরে বীরভূম জেলার এক ঐতিহাসিক গ্রাম রাইপুর। এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের নানা ঘটনাবলী। বলা যেতে পারে রাইপুরে কালে কালে সৃষ্টি হয়েছে নানা ইতিহাস, যার দরুণ রাইপুর সকলের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

১৭৮০ থেকে ৯০ সাল নাগাদ বীরভূম জেলার রাইপুর গ্রামের অজয় নদের তীরে ভাগে ভাগে তৈরি হয় রায়পুরের রাজবাড়ি । মেদিনীপুরে চন্দ্রকোনা থেকে প্রায় এক হাজার তাঁত শিল্পীকে নিয়ে বীরভূমের রায়পুর গ্রামে চলে এসেছিলেন লালচাঁদ সিংহ । জনশ্রুতি রয়েছে, বর্গী আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতেই সেই সময় তিনি বীরভূমে চলে এসেছিলেন । তবে জমিদারিত্ব শুরু করেছিলেন তাঁর ছেলে শ্যামকিশোর সিংহ । এই শ্যামকিশোর সিংহের তিন ছেলে । জগমোহন, ভুবনমোহন ও মনমোহন সিংহ । সম্ভবত, এই ভুবনমোহন সিংহের নামানুসারে 'ভুবনডাঙা' গ্রামের নামকরণ হয়েছিল । মনমোহন সিংহের তিন ছেলে । নীলকণ্ঠ, শ্রীকণ্ঠ ও সিতিকণ্ঠ সিংহ । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "জীবনস্মৃতি"-তে এই শ্রীকণ্ঠ সিংহ 'শ্রীকণ্ঠবাবু' নামে উল্লিখিত রয়েছেন । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে 'শান্তিনিকেতনের বুলবুল' নামে আখ্যায়িত করেছিলেন।



প্রথম মতানুসারে, বোলপুরের অজয় নদের তীরে আদমপুর নামক একটি অঞ্চলে স্থানীয় লোকজন আগে বসবাস করত। অজয় নদে বন্যার ফলে স্থানীয় লোকজনের সাথে সাথে রায়চৌধুরীরাও উত্তরের দিকের জমিতে(বর্তমানের রায়পুর) উঠে এসে নতুন করে বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করে। এরপর ধীরে ধীরে জমিদারি বিস্তৃত হতে থাকে রায়চৌধুরীদের। ভারতের বর্গী আক্রমনের সময় সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে, বর্গী হামলাকে দক্ষতার সাথে প্রতিহত করেন, তৎকালীন জমিদার জিতানাথ দত্তচৌধুরী। এই খুশীতে সম্রাট আলিবর্দী খাঁ তাঁকে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি দেন এবং সঙ্গে পুরস্কার বাবদ দেন এক হাজার টাকা ও বাড়ির গোপীনাথ ঠাকুরের নামে এক হাজার বিঘা জমি। এই রায়চৌধুরীরাই পরবর্তীকালে রায়পুর বা রাইপুর রাজবাড়ি তৈরি করে বসবাস করা শুরু করেন।



 দ্বিতীয় মতানুসারে, ১৭৬৪ সালে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা থেকে সিংহ পরিবারের আদিপুরুষ লালচাঁদ দে অজয় নদের তীরে, এই ছোট্ট গ্রাম রায়পুরে চলে আসেন। এখানে আসবার পর স্বচেষ্টায় ব্যবসা দাঁড় করাবার উদ্যোগ নিয়ে, তিনি প্রায় এক হাজার তন্তুবায়কে নিয়ে এসে কাজে যুক্ত করেন। ১৭৭০ সালে চৌধুরীদের থেকে জমিদারি কিনে আসতে আসতে এই গ্রামের স্থানীয় জমিদার রূপে পরিগনিত হন লালচাঁদ। এর পরবর্তীকালে এই পরিবারের আরেক রাশভারী ব্যক্তি বিশ্বম্ভর সিংহ বর্ধমানের রাজার থেকে ‘রায়’ খেতাব পান এবং বলা হয় সেখান থেকেই আদমপুর পরবর্তীকালে ‘রায়পুর’ বা ‘রাইপুর’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর সিনহারাই এই অঞ্চলে "রায়পুর জমিদারবাড়ি" গড়ে তোলেন।



এই পরিবারের সবচেয়ে স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন স্যার সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ। বাড়িতে না জানিয়ে দুই ভাই মিলে চুপিচুপি বিলেত যাত্রা করার পর, ১৮৮৬ সালে ‘লিঙ্কনস ইন’ থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরপর ১৯১৫ সালের ২৭শে ডিসেম্বর জাতীয় কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনে, সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত হন এবং ১৯১৯ সালে ব্রিটেনের সংসদ, হাউস অব লর্ডসের ভারতীয় সদস্য হন। এরপর ১৯২০ সালে বিহার-উড়িষ্যার গভর্নর পদে নিযুক্ত হলে, তৎকালীন সরকার বাহাদুরের তরফ থেকে তাঁকে ‘নাইট’ উপাধিও দেওয়া হয়। এর কিছুদিনের মধ্যেই সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ পরিচিত হন "লর্ড সিনহা" নামে এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রায়পুরের “রাজা” হিসেবে ঘোষণা করেন।

কলকাতায় শেক্সপিয়ার সরণী আর এলগিন রোড ঘেঁষা এখনো একটা রাস্তার নাম “লর্ড সিনহা রোড” নামেই পরিচিত। 

আরও পরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে সিতিকণ্ঠ সিংহের ছেলে সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের । এই সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন প্রথম ও একমাত্র বাঙালি , যিনি 'লর্ড' উপাধি পেয়েছিলেন । এছাড়াও, পরাধীন ভারতবর্ষের বিহার ও ওড়িশার গভর্নর ছিলেন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশ সফরের সঙ্গীও ছিলেন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ । বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল । অনুমান করা হয় বিশ্বভারতীর 'সিংহসদন'-এর নামকরণ রায়পুর রাজবাড়ির মালিকদের 'সিংহ' উপাধি অনুসারেই হয়েছে ।

রাজবাড়ির সামনে লাগোয়া মন্দিরে রয়েছেন কুলদেবতা নারায়ণ। মন্দিরের সামনে চওড়া চাতাল ও উল্টোদিকে নহবতখানাও রয়েছে। এখনো প্রতিদিন দু’বেলা নিত্যসেবা হয়ে থাকে এখানে।

দোতলার পিলারগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হয় , এই বাড়িটার কোন একটা ঘরে হয়তো জলসা হত এককালে। যেন দেওয়ালে কান পাতলে এখনো সেসব উচ্ছল মুহূর্তের ইতিহাস, ফিসফিসিয়ে কথা বলবে কখনো-সখনো।

ক্রমে বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসে। একটা হালকা নীল আলো ছড়িয়ে পড়ে রাজবাড়ির সর্বত্র জুড়ে। ডানদিকের দেওয়াল ধরে হাঁটলে , হঠাৎ চিঁ চিঁ শব্দ করে দুটো চামচিকে উড়ে যাবে  ঠিক পাশ দিয়ে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করে জঙ্গলের আনাচকানাচ থেকে। সন্ধে-রাত্তিরের দিকটায় বাড়ির কোনো কোনো অংশের চাঙর খসে পড়বার তীব্র আর্তনাদে আর আমগাছের দুলুনিতে কখনো-সখনো অতৃপ্ত অশরীরীর ঠাণ্ডা বাতাস খেলা করে যায় হয়তো।

ঐতিহ্যবাহী শান্তিনিকেতন ব্রহ্ম আশ্রম ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সূচনা যে বাড়ি থেকে হয়েছিল, সেই রায়পুর বা রাইপুর রাজবাড়ি আজ ধ্বংসের মুখে । চারপাশে শুধুই ঝিঁঝির ডাক । আর নিস্তব্ধতা । খসে পড়েছে দেওয়াল । বেরিয়ে পড়েছে ইঁট । ইঁটের খাঁজে খাঁজে গাছের ঝুরি । জমেছে শ্যাওলা । বৃহদাকার অট্টালিকার ছাদ থেকে দেখা যায় অজয় নদ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা । ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হিসেবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন আশ্রম আজ উজ্জ্বল নক্ষত্র । আর এই ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লেখা রয়েছে ভগ্নপ্রায় "রায়পুর রাজবাড়ি"র প্রতিটিতে ইঁটে।


আনুমানিক ১৮২৫ থেকে ২৬ সাল থেকেই প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে রায়পুরের সিংহ পরিবারের যোগাযোগ ছিল । পরবর্তীকালে যখন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন, তখন সিংহ পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আরও নিবিড় হয় । ভুবনমোহন সিংহের ছেলে প্রতাপনারায়াণ সিংহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন । অনুমান করা হয়, বীরভূম জেলার মধ্যে তিনিই প্রথম ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন । তাই প্রায় সময় রায়পুরের এই রাজবাড়িতে আসতেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর । উপরের একটি ঘর তাঁর জন্য সর্বদা বরাদ্দ ছিল । তিনি এলেই ওই ঘরে থাকতেন । যেহেতু প্রতাপনারায়াণ সিংহকে তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন, তাই এই রাজবাড়িতে গুরুদেবের আসনে সমাদৃত ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর । সিংহ পরিবারের বাড়ি হলেও এটি এখনও "রায়পুর রাজবাড়ি" নামে খ্যাত।

সংগৃহীত

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot