Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

Tuesday, December 24, 2024

বাংলার ইতিহাসে হুগলি জেলা



অনেকের মতে হোগলা শব্দটি থেকে হুগলি জেলার নামের উৎপত্তি হয়েছে। সেকালে ভাগীরথী নদীর তীরে অনেক হোগলাগাছ জন্মাত। পর্তুগিজরা যখন হুগলি অঞ্চলে তাঁদের ব্যবসার জন্য কুঠি তৈরি করেন, তখন থেকে তাঁদের মুখে মুখে হোগলা শব্দটি হুগলিতে পরিণত হয়ে যায়। আবার অনেকে বলেন যে, হুগলি শব্দটি মূলতঃ পর্তুগিজ ওগলি শব্দ থেকে এসেছে, পর্তুগিজ ভাষায় যার অর্থ হল গুদাম ঘর। অতীতে হুগলি অঞ্চলে বণিকদের মালপত্র রাখবার জন্য অনেক গুদাম ঘর তৈরি করা হয়েছিল জায়গাটার নাম হয়ে গিয়েছিল ওগলী, পরবর্তী সময়ে লোকমুখে এই নাম বদল হয়ে বলা হয় হুগলি। ইউরোপীয় বণিকেরাই হুগলি জেলার পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভাগীরথীর নাম দিয়েছিল হুগলি নদী, যে নামটি আজও প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীনকালে হুগলি অঞ্চল বর্ধমান-ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে ১৭৯৫ সালে ইংরেজরা বর্ধমানকে দু’ভাগে ভাগ করে দক্ষিণ অংশের নাম দিয়েছিলেন হুগলি জেলা; আর তারপরে নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অবশেষে ১৮৩৯ সালে হুগলি নিজের বর্তমানের রূপটি পেয়েছিল। এখন এই জেলাটির উত্তরে বর্ধমান, পশ্চিম দিকে বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর এবং দক্ষিণে হাওড়া জেলা অবস্থিত। হুগলি জেলার সমতল ভূমি ভাগীরথী নদীর পলিমাটি দিয়ে তৈরি হলেও শুধুমাত্র এই জেলার পশ্চিমপ্রান্তে গোঘাট মহকুমায় রাঢ় অঞ্চলের রুক্ষ পাথুরে মাটি দেখতে পাওয়া যায়। ভাগীরথী ছাড়া দামোদর ও দ্বারকেশ্বর নদও এই জেলাটির মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী হুগলি জেলার বিশেষ একটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে। ইতিহাস বলে যে, সুপ্রাচীন সমুদ্রবন্দর তাম্রলিপ্তের গৌরবযুগের অবসান ঘটবার পরে সরস্বতী নদীতীরের সপ্তগ্রাম পূর্ব ভারতের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র ও বন্দর-রূপে গড়ে উঠেছিল। তখন সপ্তগ্রামের বন্দর থেকে দূর সমুদ্র পাড়ে অবস্থিত সিংহল, সুমাত্রা, জাভা, বালি প্রভৃতি দেশে বাঙালি বণিকেরা বাণিজ্য যাত্রা করতে যেতেন। তৎকালীন ইউরোপের বাজারে সপ্তগ্রামের বন্দর থেকে আমদানি করা সুক্ষ্ম কার্পাস বস্ত্রের প্রচুর চাহিদা ছিল। সেযুগের সুসভ্য রোমান রমণীরা বাঙালি তাঁতির তৈরি কাপড় পরে গৌরব বোধ করতেন। আজও হুগলি জেলার ধনিয়াখালি, সিমুলিয়া, ফরাসডাঙা, রাজবলহাট প্রভৃতি অঞ্চল উত্তম বস্ত্রের জন্য খ্যাতির অধিকারী। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে সপ্তগ্রামের উল্লেখ এভাবে পাওয়া যায়—
কত ডিংগা লয়্যা তারা বাণিজ্যায় আইসে॥
সপ্তগ্রামের বণিক কোথায় না যায়।
ঘরে বসে সুখ মোক্ষ নানা ধন পায়॥”
মুসলমান শাসনামলে সপ্তগ্রাম হুগলি জেলার সদর কর্মস্থল ছিল। তখন বাংলার নানা অঞ্চল থেকে নানা বর্ণের মানুষ নিজেদের জীবিকার তাগিদে গঙ্গাতীরের দেশ হুগলিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। সপ্তগ্রামই সেকালে তাঁদের কর্মকেন্দ্র ছিল। কিন্তু সরস্বতী নদী মজে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সপ্তগ্রামের মর্যাদা হ্রাস পেয়ে গিয়েছিল এবং এরপরেই হুগলি জেলার অন্য একটি বন্দর ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল, সেই বন্দরটিই ছিল হুগলি। হুগলিতে যখন পর্তুগীজরা প্রথম উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন হিরণ্য দাস ও গোবর্ধন দাস নামের দুই ভাই সপ্তগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন। এঁরা দক্ষিণরাঢ়ী কায়স্থ ছিলেন। তৎকালীন নবাব সরকারের কাছ থেকে এঁরা যথাক্রমে রাজা ও মজুমদার উপাধি পেয়েছিলেন। এঁদের বার্ষিক ত্রিশলক্ষ টাকা আয়ের জমিদারি ছিল, যার মধ্যে থেকে বারো লক্ষ টাকা এঁরা গৌড়েশ্বরকে খাজনা দিতেন। এই দুই ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোবর্ধন দাসের পুত্র ছিলেন রঘুনাথ দাস। তিনি অসাধারণ মেধাবী ছিলেন, সংস্কৃতশাস্ত্রে তাঁর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। কিন্তু নিজের অগাধ ঐশ্বর্য ও সুন্দরী স্ত্রীকে ত্যাগ করে একটাসময়ে তিনি শ্রীচৈতন্যের চরণাশ্রয় নিয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যের ছ’জন শ্রেষ্ঠ পরিকরের মধ্যে শুধুমাত্র রঘুনাথই কায়স্থ ছিলেন। সপ্তগ্রামে রঘুনাথের প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন বিগ্রহের বর্তমান মন্দিরটি ঊনিশ শতকের বাংলার দানবীর মতিলাল শীলের পিতামহীর দানে নির্মিত হয়েছিল। এটা এখন রঘুনাথ দাসের শ্রীপাট নামে খ্যাত। এই রঘুনাথের পিতা রাজা গোবর্ধন দাসের কাছ থেকে ভাগীরথী তীরে কিছু জমি কিনে নিয়ে গোলাঘাট নামক জায়গায় পর্তুগিজরা একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন এবং সেখানেই প্রথম হুগলি শহরের পত্তন হয়েছিল। এরপরে হুগলি জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে ব্যাণ্ডেল নামক জায়গায় পর্তুগিজরা নিজেদের একটি বন্দর তৈরি করেছিলেন। তারপরে সেখানে ১৫৯৯ সালে তাঁরা একটি গির্জাও তৈরি করেছিলেন, যেটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে এবং যা আজও বাংলার প্রাচীনতম গির্জা। হুগলির বাণিজ্য থেকে পর্তুগিজদের প্রচুর অর্থলাভ হত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কাছে হেরে গিয়ে বোম্বেটেগিরি করাকেই তাঁরা নিজেদের বেশি পছন্দের জীবিকা হিসেবে ঠিক করে নিয়েছিলেন। তখন থেকেই দক্ষিণ বাংলার গ্রামগুলো থেকে তাঁরা বালক-বালিকাদের চুরি করে নিয়ে গিয়ে বিদেশে দাসরূপে করতে শুরু করেছিলেন এবং সুযোগ পেলেই গ্রামগুলোকে আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে নিরীহ মানুষদের ঘরে আগুন লাগিয়ে তাঁদের জানমানে শেষ করবার কাজে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এমনকি তখন এমন কোন কুকার্য ছিল না, যেগুলি তাঁরা করেননি। অবশেষে একটা সময়ে তাঁদের এসব সংবাদ দিল্লীর বাদশাহ শাহজাহানের কানে পৌঁছালে তিনি মহা-বিরক্ত হয়ে উঠে হুগলি থেকে পর্তুগীজদের বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে হুগলির অধিকার নিয়ে ইংরেজ ও মোঘলদের মধ্যে বার বার সংঘর্ষ হয়েছিল।
পর্তুগিজরা হুগলিতে আসবার আগে বাংলার সেন-রাজবংশের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান পীর, গাজী আউলিয়ার দল বাংলার মধ্যে প্রবেশ করে নিজেদের আস্তানা গেড়ে বসেছিলেন। তখন সেন-রাজাদের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে বা রাঢ়বঙ্গে শেষ হয়ে গেলেও ছোট ছোট হিন্দু রাজার কোন অভাব ছিল না। আর সুদূর দিল্লী থেকে তাঁদের উপরে প্রভাব বিস্তার করাও সহজ ছিল না। ওই সময়ে তাই বিভিন্ন হিন্দুরাজার রাজ্যে বাস করে এসব পীর, গাজীর দল ইসলামধর্ম প্রচার করতেন আর মুসলমানদের উপরে কোন অন্যায় আচরণ ঘটলেই দিল্লীর সুলতানকে সেকথা জানিয়ে দিতেন। তখন দিল্লীর সৈন্য এসে সেই হিন্দুরাজ্য দখল করত। এমনি করেই একদিন হুগলি অঞ্চলের পাণ্ডুয়া, মহানাদ ও ত্রিবেণীতে মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মালদহ জেলার পাণ্ডুয়ার মত হুগলির পাণ্ডুয়াও ইতিহাস বিখ্যাত। কথিত আছে যে, বুদ্ধদেবের এক পিতৃব্যপুত্র এই পাণ্ডু-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সেই বংশের পাণ্ডুদাস নামের কোন এক রাজা ছোট পেঁড়ো বা পেঁড়ো বসন্তপুরে নিজের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু জনৈক নগর ঘোষের বিশ্বাসঘাতকতায় এই পাণ্ডুরাজা দিল্লীর তৎকালীন সুলতান ফিরোজশাহের ভ্রাতুষ্পুত্র শাহসুফীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন এবং পাণ্ডুয়া শাহসুফীর দখলে চলে গিয়েছিল। এরপরে পাণ্ডুয়ার হিন্দুযুগের মঠ, মন্দির ধ্বংস করা হলেও শুধুমাত্র ১৩৬ ফুট উঁচু একটা মন্দির স্তম্ভ বিজয় স্তম্ভরূপে রক্ষা করবার জন্য শাহসুফী আদেশ দিয়েছিলেন। এরপরে সেটিকে সংস্কার করিয়ে দিল্লীর কুতবমিনারের আকারে গঠন করা হয়েছিল। বর্তমান বাংলায় যে ক’টি প্রাচীন গৃহ বা মিনার আজও টিকে রয়েছে, এটি সম্ভবতঃ সেগুলির মধ্যে সবথেকে বেশি প্রাচীন। পাঁচতলা এই মিনারের মধ্যে ১৬১টি ধাপ-বিশিষ্ট ঘোরানো সিঁড়ি রয়েছে। আজও প্রতি বছর বৈশাখ ও মাঘ মাসের প্রথম দিনে এই মিনারের নিচে মেলা বসে। এছাড়া শাহসুফীর সমাধি স্থানও এখানকার একটি দ্রষ্টব্য বস্তু। এই সমাধিটির একটি শিলালিপি আরবি হরফে লেখা হলেও সেটার পিছন দিকে সূর্যদেবের মূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে বলে দেখা যায়। এথেকে মনে হয় যে, খুব সম্ভবতঃ মালদহের গৌড়-পাণ্ডুয়ায় একটাসময়ে যেমন হিন্দু-মঠ-মন্দির মসজিদে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল, হুগলির পাণ্ডুয়া-ত্রিবেণীতেও ঠিক তেমনি ব্যাপারই ঘটেছিল। ত্রিবেণীর জাফর খাঁর পাঁচ গম্বুজওয়ালা মসজিদের শিলালিপির পিছনেও হিন্দু দেবদেবীদের মূর্তি রয়েছে এবং অতীতে এই মসজিদের কাছে পাওয়া পাথরে উৎকীর্ণ সংস্কৃতলিপির সন্ধানও পাওয়া গিয়েছিল। তাছাড়া মসজিদের সংলগ্ন সমাধি ভূমি থেকে শুধু হিন্দু দেবদেবীর নয়, বৌদ্ধ ও জৈন মূর্তির সন্ধানও পাওয়া গিয়েছিল। ত্রিবেণীর জাফর খাঁর মসজিদটি বাংলার সবথেকে পুরোনো মসজিদ। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে ত্রিবেণীর যে উল্লেখ রয়েছে, সেটা এরকম—
“বামদিকে হালিশহর, দক্ষিণে ত্রিবেণী।
যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি॥”
গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলনস্থল বলেই এই জায়গাটার নাম হল ত্রিবেণী। অতীতে ইতিহাস প্রসিদ্ধ সপ্তগ্রামের সঙ্গে ত্রিবেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেকালে সমুদ্রগামী জাহাজগুলি সপ্তগ্রাম যাওয়ার পথে ত্রিবেণীতেই নোঙর করত। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতক পর্যন্ত ত্রিবেণী পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সময় থেকে সংস্কৃত শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ত্রিবেণীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। জগন্নাথ পণ্ডিত বাংলার ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন। ১৬৯৪ সালে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ত্রিবেণীতে চব্বিশ বছর বয়সে টোল খুলে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন, এবং নিজের মৃত্যুর একমাস আগে পর্যন্ত তিনি একটানা অধ্যাপনাই করে গিয়েছিলেন; অর্থাৎ প্রায় নব্বই বছর ধরে একটানা অধ্যাপনা করে সেযুগের অধ্যাপনার ইতিহাসে তিনি একটি রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন বললেও ভুল বলা হয় না। সেকালে সংস্কৃত চর্চার জন্য নবদ্বীপের খ্যাতি ছিল এবং বাংলার অক্সফোর্ড বলে পরবর্তীকালে নবদ্বীপকে গণ্য করাও হয়েছিল। সেই নবদ্বীপের বিদ্যাচর্চার খ্যাতিকে নিজের একক প্রতিভায় ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন নিষ্প্রভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। অতি অল্প বয়সেই তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্ফুরণ দেখা গিয়েছিল। এসম্বন্ধে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। সেগুলির মধ্যে একটি কাহিনী এরকম—একদিন বালক বয়সে জগন্নাথ তাঁর জ্যাঠা ভবদেব ন্যায়ালঙ্কারের বাঁশবেড়িয়ার টোলে যখন স্মৃতিশাস্ত্র পড়ছিলেন, তাঁর জ্যাঠা ভবদেব তখন তাঁর এক ছাত্রকে স্মৃতিশাস্ত্রের কূটবিষয়ের মীমাংসা গ্রন্থ ‘দ্বৈতনির্ণয়’ পড়াচ্ছিলেন। এই গ্রন্থটি ভবদেবেরই জ্যাঠামহাশয় চন্দ্রশেখর বাচস্পতির রচনা ছিল। কিন্তু গ্রন্থের একজায়গার অর্থ দুরূহ হওয়ার কারণে সেই অর্থের কোন নিষ্পত্তি না করতে পেরে ভবদেব তাঁর ছাত্রকে বলেছিলেন যে, সেই জায়গাটার অর্থ তাঁর জ্যাঠামশায় ঠিকমত ধরতে পারেন নি। জগন্নাথ যেহেতু কাছেই বসে পড়ছিলেন সেহেতু তিনি গোটা ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি তখন হেসে উঠে নিজের জ্যাঠামশাই ভবদেবকে বলেছিলেন যে, মহাশয়ের জ্যাঠামহাশয় অর্থ ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন, তবে আমার জ্যাঠামহাশয় অর্থটি ধরতে পারছেন না! একদিক থেকে এটাকে তাঁর জ্যাঠামো বলে মনে হলেও ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম কিছু ছিল না। বাস্তবে জগন্নাথের অগাধ পাণ্ডিত্যের কথা সেকালের ইংরেজ শাসকদেরও অজ্ঞাত ছিল না। তাই যখন হিন্দুদের দেওয়ানি মামলার বিচারের সময়ে একটা ব্যবহার-শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল, তখন প্রাচ্যতত্ত্ববিদ উইলিয়াম জোন্সের অনুরোধে তিনবছর পরিশ্রম করে জগন্নাথ হিন্দুদের ‘ব্যবহার-শাস্ত্র বিবাদ-ভঙ্গার্ণব’ নামক গ্রন্থটি রচনা করে দিয়েছিলেন। সেকালে প্রচলিত থাকা হিন্দুশাস্ত্রের নানা বিরুদ্ধ মতামতের ভেতরে সামঞ্জস্য বিধান করে এমন একটি সুষ্ঠু গ্রন্থ রচনা যে কত বড় মেধাশক্তির পরিচয় ছিল, সেকথা এযুগের সাধারণ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। পরে সুপণ্ডিত কোলব্রুক সাহেব এই গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ১৮০৭ সালে একশো তেরো বছর বয়সে জগন্নাথের মৃত্যু হয়েছিল। এর কিছুকাল আগে থেকেই শ্রীরামপুরের খৃষ্টান মিশনারিরা বাংলা গদ্য ভাষার পুস্তক রচনা করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলেন।
শ্রীরামপুরের বিখ্যাত পণ্ডিত মিশনারি উইলিয়াম কেরী ১৮১৮ সালে বাংলা ভাষার প্রথম মাসিক পত্র ‘দিগদর্শন’ প্রকাশ করেছিলেন। সেই বছর থেকেই আরেকজন মিশনারি—জোশুয়া মার্শম্যানের সম্পাদনায় বাংলার প্রথম বাংলা ভাষার সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপরে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকাটি একটানা প্রকাশিত হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
উইলিয়াম কেরী এদেশে খৃষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আসলেও ধর্মপ্রচারের থেকে দেশীয় ভাষা শিক্ষা ও বিদ্যার অনুশীলনের জন্য তিনি আজও ইতিহাসে খ্যাতিমান রয়েছেন। বাংলা কথ্যভাষা শিক্ষা করবার জন্য তিনি গ্রামের চাষি, মজুর, জেলে ইত্যাদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বাংলা ভাষায় যে ক’টি পুস্তক রচনা করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে ‘ইতিহাস মালা’ ও ‘কথোপকথন’ সবথেকে উল্লেখযোগ্য। তাঁর মুনসী রামরাম বসু বাংলা ভাষা শিক্ষার কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন। ইনি ১৮০১ সালে ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ বলে একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন, এই গ্রন্থটিই বাংলা ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত প্রথম কোন গদ্য পুস্তক ছিল। আজও এই পুস্তকের বিশেষ একটি ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। উইলিয়াম কেরী ও রামরাম বসুর পুস্তকগুলি শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস থেকে ছাপা হলেও এর আগেই অবশ্য ১৭৭৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী সুপণ্ডিত স্যার চার্লস উইলকিন্স হুগলিতে মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেছিলেন। সেটাই ছিল ভারতবর্ষের প্রথম কোন ছাপাখানা।
একটা সময়ে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য হুগলির ইংরেজ কর্মচারী মিস্টার ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড প্রথম বাংলা ভাষায় ব্যাকরণটি রচনা করেছিলেন এবং এটিও পূর্বোক্ত ছাপাখানাতেই মুদ্রিত হয়েছিল। তখন ছাপাখানার জন্য বাংলা হরফ পাওয়া যেত না বলে হ্যালহেড সাহেব প্রাচীন বাংলা পুঁথি দেখে কাঠে খোদাই করে বাংলা হরফ তৈরি করবার চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন। এ কাজে তৎকালীন হুগলি জেলার বড়া গ্রামের পঞ্চানন কর্মকার সাহেবকে সাহায্য করেছিলেন। পঞ্চানন কর্মকারের তৈরি কাঠের হরফ দিয়েই হ্যালহেড সাহেবের বাংলা ব্যাকরণ ছাপা হয়েছিল।
হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার গোঘাট থানার অন্তর্ভুক্ত গড় মান্দারণে অতি প্রাচীনকালে একজন হিন্দুরাজার রাজধানী ছিল। তখন জায়গাটির নাম ছিল বিধুর গড়। সেই রাজার প্রাসাদ বা দুর্গের প্রাচীর চার-পাঁচ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং সেটির উচ্চতা ছিল বিশ থেকে ত্রিশ ফুট। এই দুর্গ মূল ছুঁয়ে তখন দামোদর নদী বয়ে যেত। সমকালে হোসেন শাহ গৌড়ের শাসক ছিলেন। তাঁর সেনাপতি ইসমাইল গাজী গড়মান্দারণের হিন্দুরাজা গজপতিকে পরাজিত করে তাঁর দুর্গ ও প্রাসাদ বিধ্বস্ত করলেও সেই জয়ের সুখ তিনি ভোগ করতে পারেননি। কারণ, এরপরেই রাজা গজপতির সেনাপতি ভান্দসী রায় গাজী ইসমাইলকে ঘোড়াঘাট নামক জায়গায় যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করেছিলেন। রাজা গজপতির দুর্গ ও প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ আজও সেই অতীত ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সুপ্রসিদ্ধ ‘দুর্গেশনন্দিনী’ গ্রন্থে এই গড়মান্দারণের কথাই লিখেছিলেন। আকবরের প্রসিদ্ধ সভাসদ আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই- আকবরী’ গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, মুঘলযুগে গড়মান্দারণের কাছেই হাজিয়া নামক একটি জায়গায় হীরা পাওয়া যেত। গড়মান্দারণের খুব কাছে অবস্থিত পশ্চিম পাড়ায় ধর্মমঙ্গল-রচয়িতা খেলারাম চক্রবর্তীর জন্মস্থান।
সুদূর অতীতে হুগলি জেলার সিঙ্গুরের প্রাচীন নাম ছিল সিংহপুর। শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত এই জায়গায় খৃষ্টের জন্মের বহু বছর আগে সিংহবাহু বলে একজন রাজা রাজত্ব করতেন। কথিত রয়েছে যে, বুদ্ধদেবের পরিনির্বাণের বছরে তাঁর পুত্র বিজয়সিংহ মাত্র সাতশো অনুচর সহ বাঙালি শিল্পীর হাতে গড়া পালতোলা জাহাজে চড়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সুদূর তাম্রপর্ণী বা লঙ্কা দ্বীপে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। এরপরে বিজয়সিংহ লঙ্কা অধিকার করে নিয়ে সেখানকার রাজকন্যা অনুরাধাকে বিবাহ করেছিলেন। তারপরে বিজয়সিংহ লঙ্কাদ্বীপের নতুন রাজধানীর নাম রেখেছিলেন অনুরাধাপুর; কালক্রমে লঙ্কা দ্বীপের নামও পরিবর্তিত হয়ে সিংহল হয়ে গিয়েছিল। বিজয়সিংহের পিতার নামানুসারে তাঁর রাজ্যের নাম ছিল সিংহপুর। এই সিংহপুর থেকেই কবি কালিদাস সিংহলে গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বর্তমান সিঙ্গুরের মাইল চারেক উত্তরে সিংহলপাঠান বলে একটা গ্রাম রয়েছে। অতীতের বাংলার প্রসিদ্ধ গোপাল উড়ের বিদ্যাসুন্দর যাত্রাপালার সঙ্গীত-রচয়িতা ভৈরব হালদারের বাড়িও সিঙ্গুরে ছিল।
বর্তমান হুগলি জেলার একটি বড় তীর্থস্থানের নাম হল তারকেশ্বর। এখানকার শৈব-মঠটি মাত্র দু’শো বছর আগে উত্তর ভারত থেকে আগত শৈব-সন্ন্যাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই শৈব-সন্ন্যাসীরা শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত দশনামী সম্প্রদায়ের ছিলেন। খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় যে রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটেছিল, সেই বিপর্যয়ের সুযোগে তখন উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ ভারত থেকে নানাজাতির সুযোগ-সন্ধানী মানুষেরা বাংলায় ছুটে এসেছিলেন। বর্গীদের সামরিক অভিযানে বাংলার সমাজ-জীবন তখন বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই সময়েই মায়াগিরি বলে জনৈক শৈব-সন্ন্যাসী তারকেশ্বর মঠটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারকেশ্বরকে লোক-সংস্কৃতির সমন্বয়ভূমি বলা চলে। তারকেশ্বরের শিবের আরেক নাম হল তারকনাথ। অতীতের একটাসময়ে হুগলি জেলা নাথধর্মের বড় প্রচার-কেন্দ্র ছিল। আজও এই হুগলি জেলাতেই নাথধর্মের সবথেকে বড় কেন্দ্র মহানাদে শিব, জটেশ্বরনাথ নাম ধারণ করে রয়েছেন বুলে দেখা যায়। মোহন্তরা তারকেশ্বরে আসবার আগে, গোপ জাতীয় মুকুন্দ ঘোষ এখানকার শিবের পূজক ছিলেন। ইনি স্থানীয় রাজা ভারামল্লের গো-পালক ছিলেন। একদিন গভীর অরণ্যে সম্ভবতঃ গরু চরাবার সময়েই মুকুন্দ একটি শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করেছিলেন এবং এরপরে দেবতার আদেশে তিনি সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে শিবের পূজারী হয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে মোহন্তদের আমলেই এখানে ব্রাহ্মণ পূজারি এনে শিবের পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে লোকাচার ও সংস্কৃতিকে একেবারে নির্মূল করা কঠিন বলে আজও তারকেশ্বরের গাজনের পাঁচজন মূল সন্ন্যাসীর মধ্যে চারজনই গোপজাতীয় ব্যক্তি থাকেন। তারকেশ্বর মন্দিরে তারকনাথের পাশে বাসুদেব বিরাজ করছেন বলে দেখা যায়। অতীত থেকেই চৈত্র-সংক্রান্তিতে শিবের গাজন উৎসব বাংলার একটি বড় উৎসব। আজও তারকেশ্বরে চৈত্রের প্রথম থেকেই মেলা বসে। অনেক দূর দূর অঞ্চল থেকে অসংখ্য মানুষ তারকেশ্বরের মহাতীর্থে পায়ে হেঁটে আগে যেমন পুণ্য করতে আসতেন, এখনও তেমন আসেন। অতীতে এখানকার নীলের বিরাট মেলায় হাতি নিয়ে শোভাযাত্রা করা হত। এভাবে অতীত থেকেই তারকেশ্বর দক্ষিণ-রাঢ় অঞ্চলের নানা লোকানুষ্ঠানের একটি মহামিলনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল বলে দেখতে পাওয়া যায়।
তারকেশ্বরের কাছেই রয়েছে সুপ্রাচীন হরিপাল গ্রাম। প্রাচীন কিংবদন্তী বলে যে, রাজা হরিপালের নাম থেকেই এই গ্রামের নামকরণ হয়েছে। রাজা হরিপালের সুন্দরী কন্যা কানড়াকে গৌড়ের বৃদ্ধ রাজা বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কানড়া সে প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ার কারণে গৌড়ের সৈন্যবাহিনী হরিপাল রাজ্য আক্রমণ করলে কানড়া স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে গৌড়-সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। এরপরে ময়নাগড়ের মহাসামন্ত কর্ণসেনের পুত্র ধর্মমঙ্গল-খ্যাত মহাপরাক্রমশালী লাউসেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল।
অতীতের একটাসময়ে হুগলির মহানাদ নাথধর্ম ও সংস্কৃতির এক প্রধান কেন্দ্র ছিল। প্রসিদ্ধ নাথ-যোগীদের ধর্মসাধনার সবথেকে বড় পীঠস্থানরূপে মহানাদের খ্যাতি তখন সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল এবং মহানাদে নাথদের দুটি শাখা-মঠও স্থাপিত হয়েছিল। ইতিহাস বলে যে, গুপ্তযুগেই শৈবধর্ম বাংলায় প্রবেশ করেছিল। রাজা শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক আসামের ভাস্করবর্মা কামরূপের তান্ত্রিকধারাকে নিয়ে এসে বাংলার শৈব-উপাসনার সঙ্গে যোগ করে দিয়েছিলেন। এরপরে হর্ষবর্ধন ও তাঁর পরবর্তী পালরাজাদের আমলে বাংলার শৈব-তান্ত্রিক মিলিত ধারার উপরে বৌদ্ধ রীতিনীতির প্রভাব পড়েছিল। আর এরফলেই সম্ভবতঃ বাংলায় নাথধর্মের বিকাশ ঘটেছিল। নাথযোগীরা নাদ বা ধ্বনির সাধনা করেন। তাঁরা বলেন নাদেই এই জগৎ সংসার অধিষ্ঠিত। মহানাদে এখনও কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে যে, একদা সেখানে একটি মহাশঙ্খ থেকে মহানাদ উত্থিত হয়েছিল; আর তাই নাকি জায়গাটার নাম হয়েছিল মহানাদ। মহানাদের জটেশ্বরনাথের মন্দির সম্ভবতঃ সবথেকে বেশি প্রাচীন। অতীতে এই মন্দিরের কাছেই নাথযোগীদের পাড়া ছিল। যোগীডাঙা বলে এখানকার একটা প্রাচীন গ্রাম আজও সেকথা মনে করিয়ে দেয়। এখানকার ন’টি চূড়া বিশিষ্ট তিনতলা ব্রহ্মময়ী দেবীর মন্দিরও দ্রষ্টব্য। আজও সারা মহানাদ জুড়ে নানা পুরাকীর্তির নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন যুগে সমৃদ্ধ মহানাদ নানা আক্রমণকারীদের দ্বারা ধ্বংস হয়েছিল।
প্রাচীন সপ্তগ্রামের অন্তর্ভুক্ত বংশবাটি বা বাঁশবেড়ের হংসেশ্বরী মন্দিরটি বাংলার স্থাপত্যশিল্পে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে হংসেশ্বরী দেবীর মন্দির ও মূর্তি-পরিকল্পনায় নাথধর্ম ও তন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। এই বিগ্রহটি নিমকাঠের তৈরি। মন্দিরের গঠন ও কারুকার্য অপূর্ব। জনশ্রুতি রয়েছে যে, বংশবাটির নীলকরদের অত্যাচার দেখেই নাকি নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি রচনা করেছিলেন।
হুগলির আরেকটি বিখ্যাত গ্রাম হল দেবানন্দপুর। অতীতে এটি প্রাচীন সপ্তগ্রামের সাতটি গাঁয়ের মধ্যে একটি ছিল। মুসলমান আমলে দেবানন্দপুর আরবি ফারসি শিক্ষার কেন্দ্র ছিল। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় এখানেই ফারসি অধ্যয়ন করেছিলেন। বাংলার প্রখ্যাত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতার মাতুলালয় এখানেই ছিল এবং এই গ্রামেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর লেখার অনেক জায়গাতেই দেবানন্দপুরের কথা পাওয়া যায়। বর্তমানে এখানে শরৎচন্দ্রের একটি স্মৃতিমন্দির স্থাপিত হয়েছে। প্রতি বছর বাংলার বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্রের জন্মতিথিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে উপস্থিত হন।
এছাড়া হুগলি জেলা বাংলার অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তানেরও জন্মস্থান। এর আরামবাগ মহকুমার রাধানগর গ্রাম রাজা রামমোহন রায়ের জন্মভূমি, যিনি আধুনিক ভারতবর্ষের সবথেকে প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। আর সর্বযুগের সর্বসাধনার ধারাকে আত্মস্থ করে যিনি দেশ ও জাতিকে সঞ্জীবনী মন্ত্র দিয়েছিলেন, সেই রামকৃষ্ণদেবের আবির্ভাব কামারপুকুর গ্রামে ঘটেছিল। ভারতবর্ষের আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তান পুণ্যশ্লোক বিদ্যাসাগর যখন বীরসিংহ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তখন বীরসিংহও কিন্তু হুগলি জেলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। হুগলির জাহানাবাদ পরগণার (বর্তমানের আরামবাগ মহকুমা) মধ্যে প্রায় একইজায়গায় রামমোহন, রামকৃষ্ণ ও বিদ্যাসাগরের মত যুগ-প্রতিভাদের আবির্ভাব সত্যই বিস্ময়কর।
অতীতের বাংলার ঐশ্বর্যের লোভে ইউরোপীয় বণিকেরা দলে দলে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত হুগলি জেলাতেই এসে নিজেদের ঘাঁটি গড়েছিলেন; যেমন—পর্তুগিজেরা হুগলিতে, জার্মানরা ভদ্রেশ্বরে, গ্রিকরা রিষড়ায়, দিনেমারেরা শ্রীরামপুরে, ফরাসিরা চন্দননগরে আর ডাচ বা ওলন্দাজেরা চুঁচুড়ায়। ওলন্দাজেরা বাদশাহ শাহজাহানের কাছ থেকে সনদ নিয়ে চুঁচুড়ায় নিজেদের একটা বাণিজ্য কুঠি খুলেছিলেন এবং সেখানে তাঁরা একটি দুর্গও তৈরি করেছিলেন। পরে ১৮২৯ সালে ইংরেজরা চুঁচুড়া দখল করে নিয়ে সেই দুর্গটি ভেঙে ফেলে সেখানে বিরাট এক ব্যারাক বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। একটাসময় পর্যন্ত এটাই সম্ভবতঃ বাংলার সবথেকে বড় বাড়ি ছিল। পরে এই বাড়িটিতে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের অফিস তৈরি হয়েছিল। চুঁচুড়ার আর্মেনীয় গির্জাটি বাংলার দ্বিতীয় গির্জা বলে পরিচিত। জনৈক ফরাসি সৈনিক মসিয়েঁ পেরণ চুঁচুড়ায় যে বাড়িটি তৈরি করিয়েছিলেন, পরে সেটাই হাত বদল হয়ে হুগলি মহসীন কলেজের জন্য ক্রয় করা হয়েছিল। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র এই হুগলি কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। হুগলি শহরের মধ্যে দানবীর হাজী মহম্মদ মহসীনের স্মৃতি-ধন্য প্রসিদ্ধ ইমামবাড়া ও মহসীনের সমাধি আজও একটি দর্শনীয় স্থান। ১৮৪১ সালে এই ইমামবাড়ার নির্মাণকার্য আরম্ভ হয়েছিল এবং এটি শেষ হতে কুড়ি বছর সময় লেগেছিল। এর পিছনে সেযুগের হিসেবে তিনলাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছিল বলে জানা যায়।
হুগলি চুঁচুড়া এখন মিলিত শহর। অতীতের বাংলার অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তি এখানকার অধিবাসী ছিলেন। ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ রচয়িতা রামরাম বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ও রেভারেন্ড লালবিহারী দে চুঁচুড়ায় বাস কোরতেন। অতীতের হুগলি জেলা বাংলার বহু কৃতী সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘আলালের ঘরে দুলাল’ প্রণেতা প্যারীচাঁদ মিত্রের জন্ম হয়েছিল এই জেলার পাণিশেওলা গ্রামে। সুবিখ্যাত সাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের জন্মস্থান ছিল গুপ্তিপাড়া। অতীতের বিখ্যাত পণ্ডিত, বাগ্মী, সন্ন্যাসী ও রাজনীতিক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় পাণ্ডুয়ার কাছে খন্যান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ব্রহ্মবান্ধবের সংসারাশ্রমের নাম ছিল ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজের যৌবনে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করবার জন্য গোয়ালিয়র রাজ্যে গিয়েছিলেন। এরপরে সেখান থেকে সিন্ধুদেশে গিয়েছিলেন এবং সেখানে রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টানধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরে প্রায়শ্চিত্ত করে তিনি পুনরায় হিন্দু হয়েছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য বৈপ্লবিক

ছবি ও লেখা সৌজন্যে – রানা চক্রবর্তী সংগৃহীত

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad

Your Ad Spot