হাওড়া জেলায় ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ছোট্ট গ্রাম দেউলটি। প্রাকৃতিক দৃশ্যে কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। তবে জায়গাটি অনন্য হয়ে আছে কিংবদন্তি কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। যাঁর লেখা সম্ভবত সারা ভারতে সবথেকে বেশি পঠিত, অনূদিত এবং সিনেমা-নাটকে রূপান্তরিত। ১৯২৩ সাল থেকে ১২ বছর তিনি দেউলটি লাগোয়া অঞ্চলে ছিলেন। তারপর চলে যান কলকাতায়। সেখানেই প্রয়াত হন ৩ বছর পর।
দেউলটি লাগোয়া সামতায় রয়েছে ‘শরৎ কুঠি’। ১৯১৯ সালে এখানে জমি কেনার পর শরৎচন্দ্র নিজে গ্রামটির নাম পালটে রেখেছিলেন সামতাবেড়। তাঁর জন্ম হয় হুগলি জেলার দেবানন্দপুরে। বিহারের ভাগলপুরে মামাবাড়িতেই কাটিয়েছিলেন শৈশবের বেশির ভাগ সময়।
বড়ো হয়ে কর্মসূত্রে ব্রহ্মদেশ যেতে হয় তাঁকে। ১১ বছর পর ফিরে আসেন হাওড়া জেলার বাজে শিবপুরে। জানা যায়, সামাতাবেড়ে নতুন বাড়ি তৈরি করতে ১৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। ১৯২৩-এর ফেব্রুয়ারি থেকে শরৎচন্দ্র এখানে থাকা শুরু করেন। ‘দেবদাস’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘দেনাপাওনা’, ‘দত্তা’, ‘নিষ্কৃতি’-র মতো জনপ্রিয় উপন্যাস এবং ‘মহেশ’, ‘রামের সুমতি’-র মতো বিখ্যাত ছোটোগল্প এখানে বসে লিখেছিলেন।
ব্রহ্মদেশে অনেকদিন ছিলেন শরৎচন্দ্র। সামতাবেড়ের বাড়িটিও বার্মিজ রীতির। দোতলা বাড়িতে রাখা আছে সাহিত্যিকের নিজস্ব সামগ্রী। একটি ছোটো গ্রন্থাগারও আছে। ১৯৭৮-এর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাড়িটি। সঠিক পুনর্নিমাণের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সালে। আদি কাঠামো আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ২০০১ সালের ওয়েস্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন অ্যাক্ট (৯) অনুসারে বাড়িটি পেয়েছে হেরিটেজ-হিস্টোরিক্যাল সাইটের মর্যাদা।
আশ্চর্যের কথা, যে মানুষটির জন্য দেউলটি এবং সামতাবেড়ের এত খ্যাতি, তিনি এখানে থাকতে এসে বাধার সম্মুখীন হন প্রথমে। ভারতীয় সমাজের কুপ্রথাগুলি নিয়ে সরব ছিলেন শরৎচন্দ্র। যেমন নারী নিপীড়ন কিংবা জাতিভেদ প্রথা। গ্রাম্য প্রবীণরা তাই প্রথমে তাঁকে গ্রহণ করতে চাননি। নানাভাবে উত্যক্ত করতেন। যদিও পরে সবার মন জিতে নেন শরৎচন্দ্র। তাঁর পরোপকারী কাজকর্ম গ্রামবাসীদের আকর্ষণ করে। বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য একটি হোমিওপ্যাথি চেম্বার তিনি গড়ে তুলেছিলেন, যা এখনও রয়েছে।
বাড়ির থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ নদী। শরৎচন্দ্রের সময়ে আরও কাছে ছিল। বাড়িতে আপনি দেখতে পাবেন বার্মা কাঠের আসবাব, শরৎচন্দ্রের ব্যবহৃত লেখার ডেস্ক, হুঁকো, জাপানি ঘড়ি এবং বইয়ের শেলফ। সব কিছুই যত্ন করে সাজানো।
পর্যটকদের জন্য শরৎ কুঠির দরজা খোলে সকাল ১০টায়। বিকেল ৫টায় বন্ধ হয়। আলাদা করে কোনও গাইড নেই, তবে কেয়ারটেকার আপনাকে সবকিছুই ঘুরে দেখাবেন। শীতকালে গেলে পিকনিক করতে পারবেন ছবির মতো সুন্দর রূপনারায়ণ নদীর তীরে। প্রচুর পাখি আসে নদীর ধারে। পাখিপ্রেমীরা মজা পাবেন। তাই শীতকালে বেড়াতে যাওয়াই সবচেয়ে ভালো। দেখার জায়গা খুবই কম। এক দিনেই ঘুরে আসা যায়।
এই বাড়িতেই থাকতেন শরৎচন্দ্রের দ্বিতীয় স্ত্রী হিরণ্ময়ী দেবী এবং ভাই স্বামী বেদানন্দ, যিনি বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী হন। বাগানে এঁদের সমাধি দেখতে পাবেন। নিজের হাতে শরৎচন্দ্রের রোপণ করা বাঁশ এবং পেয়ারা গাছ দেখতে ভুলবেন না।
( সংগৃহীত)
No comments:
Post a Comment